চলমান জ্বালানি সংকটে পরিবেশবান্ধব গণমুখী জ্বালানি নীতি তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন কবি ও রাষ্ট্র চিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেছেন, এই নীতি প্রণয়নে চিন্তাভাবনার ধরনেও পরিবর্তন আনতে হবে। এনার্জির কথা আমরা যখন বলি, আমাদের অবশ্যই গাছপালার কথা বলতে হবে, অবশ্যই পরিবেশের কথা বলতে হবে। যে ভাষায় বলেন না কেন, আপনাকে অবশ্যই পরিবেশ এবং প্রকৃতিবান্ধব গণমুখী জ্বালানি নীতি করতে হবে।
সোমবার সকালে রাজধানীর নিকুঞ্জে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সদর দপ্তরে ‘বিদ্যুৎ রূপান্তর কোন পথে?’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
ফরহাদ মজহার বলেন, নীতি তৈরির জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, এরই মধ্যে যে কাজগুলো হয়ে গেছে, সেগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। এ কাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বা প্রাইভেটাইজেশন বাদ দিতে হবে। বড় বড় কোম্পানির কাছে আমরা আমাদের জ্বালানি তুলে দিচ্ছি। সম্পদ কিন্তু আমাদের। কিন্তু আমলারা তুলে দিচ্ছে বিদেশি কোম্পানির হাতে। আমাদের বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিমের এই নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসি ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। কারণ, এই পলিসির বাস্তবায়ন হয় আমলাদের দ্বারা। এই আমলাতন্ত্রের বিনাশ হতে হবে। তা নাহলে আমরা আমাদের জ্বালানির সমস্যা সমাধান করতে পারব না।
সম্প্রতি দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে ফরহাদ মজহার বলেন, এখন সংকটটা কোথায় তৈরি হয়েছে? ধরেই নিয়েছি, আমরা বোধ হয় এখনো শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অধীনে আছি। এটা তো হলো না। সে কারণে আমরা যখনই পজিশনের বিরুদ্ধে দাঁড়াই আমরা কিন্তু এটা ইলিউশন থেকে বা পুরোনো অভ্যাস থেকে করেছি। এটা তো আপনাদের প্রতিষ্ঠান। এটাকে তো আমরা গড়তে পারব, সময় দেবেন। আমাদের ছাত্ররা এখনো আন্দোলন করছে। কারণ, আমরা যেটা করতে চেয়েছি, সেটা কিন্তু এখনো করতে পারিনি। ফলে সংকটটা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে রয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এটি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আছে শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় সংকট প্রতিফলিত হয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যে আন্দোলনটা চলছে, তরুণদের যে আন্দোলন চলছে এবং আমাদের সৈনিকরাও যে আন্দোলনে যুক্ত আছে নানাভাবে, সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও অনেকেই আছেন জনগণের বন্ধু, তারাও এর সঙ্গে জড়িত আছেন। এটা তো আমাদের অবস্থান।
বর্তমান সরকারের কাজের সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, রাষ্ট্রের যারা দায়িত্বে এখন আছেন, তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করুন। তাদের যত খুশি সমালোচনা করুন; কিন্তু আপনারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে এটাকে আমরা অন্তর্ঘাতমূলক হিসেবে দেখব। আমি তো সারাক্ষণই এ সরকারের সমালোচনা করছি। সরকারের সমালোচনা করছি; কিন্তু এই সরকারকে তো দুর্বল হতে আমরা দেব না। আমরা তো সামনে যাওয়ার জন্য সমালোচনা করছি, পেছনে যাওয়ার জন্য সমালোচনা না।
তিনি বলেন, সিপিডির দলিল প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে বায়াসড। আমরা আশা করব, আজকের পর তারা সরে আসবে। সিপিডির সুপারিশ বিশেষ ফোকাসড প্রাইভেটাইজেশনের পক্ষে, সেটা ভুল। জনগণের অংশগ্রহণের কোনো চিন্তা নেই তাদের ডকুমেন্টে।
এই রাষ্ট্র চিন্তক বলেন, জনগণকে বাদ দিয়ে করবেন সেটি ফ্যাসিজম, আপনি আওয়ামী লীগ হন, বিএনপি হন। আপনাকে সর্বত্র জনগণকে যুক্ত করতে হবে। সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রশাসনের সর্বস্তরে জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণকে যুক্ত করতে হবে।
সেমিনারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দুর্নীতি, চুরিগুলোর মীমাংসা হতে হবে। প্রতিটি প্রকল্প নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি রূপান্তর হচ্ছে, আমাদেরও হচ্ছে। আমাদের মাটির নিচে গ্যাস ও কয়লা আছে। কিন্তু পরিমাণ আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, বায়োমাস (জৈব জ্বালানি) নিয়ে কাজ হয়নি। এটা সেভাবে সামনে আসেনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে স্রেডাকে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। একজন অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির অধীনে রাখা হয়েছে। দাতা সংস্থাগুলো অনেক পরিকল্পনা আমাদের দিয়ে করিয়েছে। কিন্তু এসব পরিকল্পনা ও সংস্কার মানুষের অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে আমাদের জ্বালানির অধিকার বিপন্ন হয়েছে।
আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল এস এম জিয়া-উল-আজিমের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফয়েজ আহাম্মদ।