আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বায়ক ও মুখপাত্র বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু নগদ টাকায় লেনদেন করতেন। তিনি ব্যাংকের লেনদেন এড়িয়ে চলতেন। যার ফলে বিগত ১৬ বছরে ঝালকাঠিতে যত কমিশন বাণিজ্য করছেন সব নগদে করতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গত ৫ আগস্ট। সেইদিন তার ঝালকাঠির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার করা হয়। যা বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি করছে। কারণ সেইদিন বাংলাদেশের আর কোনো রাজনীতিবিদ কিংবা কোনো মন্ত্রীর বাড়ি থেকে এত পরিমাণ নগদ টাকা উদ্ধার হয়নি।
জানা যায়, আমির হোসেন আমু জাতীয় নেতা হলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল ঝালকাঠিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে জেলায় একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছিল যারা আমুর হয়ে সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিটি গঠন ও নির্বাচনী মনোনয়ন বিক্রি করত। সব টাকাই নগদে দিতে হতো আমুকে। তিনি কখনো ব্যাংকের মাধ্যমে কমিশনের টাকা লেনদেন করতেন না। এসব লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেন তার ভায়রা কিরণ। এজন্য ঝালকাঠিতে একটি প্রবাদ আছে আমু নগদে বিশ্বাসী।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর আমুর ঝালকাঠির বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ওই বাড়ি থেকে পোড়া-অক্ষত মিলিয়ে প্রায় চার কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এর আগেই আমু পালিয়ে যান। এর পর থেকে ওনার অবস্থান সম্পর্কে জানে না কেউ। বর্ষীয়ান এ নেতার নামে একাধিক মামলা হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশনায় তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া আমুর পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনও স্থগিত করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সব টাকাই নগদে দিতে হতো আমুকে। লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা তার কিরণের বাড়ি নরসিংদীতে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের ছোট ভাই কিরণ তার নিজের এলাকা বাদ দিয়ে পড়ে থাকতেন ঝালকাঠিতে। কেবল কমিশন আদায় নয়, নির্বাচনী এলাকায় আমুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও দেখাশোনা করতেন তিনি।
নলছিটি উপজেলার আওয়ামী লীগের এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে অনুমতি নিতে হতো কিরণের। নলছিটির সব কাজের ভাগ-বাটোয়ারা করতেন তিনি।’
ঝালকাঠির রোনালস রোডের বাড়ি, বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের আলিশান বাংলোবাড়ি ও ঢাকার ইস্কাটনে বাংলো বাড়ি রয়েছে আমুর।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ব্যাংকে টাকা না রেখে আমু বাড়িতেই রাখতেন। যার প্রমাণ মেলে ৫ আগস্ট। আমুর ঝালকাঠির বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন। পরে আগুন নেভানোর সময় কয়েকটি পোড়া লাগেজ থেকে টাকার বান্ডিল বেরিয়ে পড়ে। তখন সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা এসে ওই টাকার লাগেজগুলো উদ্ধার করেন। এর মধ্য থেকে তারা গণনা করে একটি লাগেজে অক্ষত ১ কোটি এবং অপর লাগেজগুলো থেকে আংশিক পোড়া ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা উদ্ধার করেন। এ ছাড়া সেখানে ডলার, ইউরোসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের মুদ্রা ছিল বলে জানায় পুলিশ।
এরইমধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেনকে (আমুকে) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার (৬ নভেম্বর) বেলা দেড়টার দিকে পশ্চিম ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আমির হোসের আমুর গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, আমির হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক ছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ (মালেক) থেকে। এর পরের যত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল, সব কটিতেই দলের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ২০০০ সালের উপনির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে দায়িত্ব পান শিল্পমন্ত্রীর। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন আমু।