ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং খাত বিশ্ব বাণিজ্যের মেরুদণ্ড সমতূল্য, যা সীমান্ত জুড়ে পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস, সামুদ্রিক খাবার, ওষুধ, কৃষি পণ্য, চামড়া, অ-পচনশীল আইটেম এবং আরও অনেক পণ্যের রপ্তানি সহজতর করার জন্য এই খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, দেশে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যা তাদের দক্ষতার সাথে কাজ পরিচালনা করার ক্ষমতাকে বাঁধা দেয় এবং বাণিজ্য সহজীকরণে সর্বোত্তমভাবে অবদান রাখে।
ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের ভূমিকার স্বীকৃতির অভাব:
স্টেকহোল্ডাররা যেমন- উৎপাদক, রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারকরা প্রায়শই ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করে। তাদের কৌশলগত অংশীদারের পরিবর্তে কেবল পরিষেবা প্রদানকারী হিসাবে গণ্য করে। এর ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাস ব্যহত হয়।
বাংলাদেশে নীতি প্রণয়নে খুব কমই ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার বা অন্যান্য মূল স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করা হয়। এর ফলে এমন নীতি তৈরি হয় যা প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয় এবং জটিলতা তৈরি করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, সরকারী সংস্থা, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাঙ্কগুলির সাথে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা প্রায়শই সমস্যার সম্মুখীন হন। নিয়ন্ত্রক এবং সুবিধাদাতারা এখনও বাণিজ্য সহজীকরণে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের কৌশলগত গুরুত্ব পুরোপুরি স্বীকার করতে পারেনি।
লাইসেন্সিং এবং নিয়ন্ত্রক সমস্যা: এনবিআর দ্বারা নির্ধারিত লাইসেন্স এর প্রবিধানগুলো পুরানো এবং এর জরুরী সংশোধন প্রয়োজন। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের প্রতিটি বন্দরের জন্য আলাদা লাইসেন্স পেতে হয়, যা শুধু অপারেশনাল জটিলতা বাড়ায়। সারা বাংলাদেশে একটি ইউনিফাইড লাইসেন্স এর ব্যবস্থা থাকলে তা এই কার্যক্রমকে সুগম করবে।
কাস্টমস কার্যক্রমে অদক্ষতা:
কাস্টমস কার্যক্রমের অদক্ষতার কারণে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা প্রায়ই অযথা বিলম্বের সম্মুখীন হয়। দীর্ঘ লাইন এবং প্রতিদিনের আনুষ্ঠানিকতার ধীর প্রক্রিয়া এই বিলম্বের প্রধান কারণ। ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (আইজিএম) এবং এক্সপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট (ইজিএম) ঘিরে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত এবং জটিল প্রক্রিয়াগুলো ফ্রেইট ফরোয়ার্ডদের দক্ষতা এবং প্রতিযোগিতা আরও কমিয়ে দেয়।
কাস্টমসের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায়ই বিলম্ব, জরিমানা এবং অপ্রয়োজনীয় জটিলতা দেখা দেয়। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা প্রায় সময় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথাযথ কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছাতে ঝামেলায় পরে। সময়মত যোগাযোগের অভাবও এই বিলম্ব বৃদ্ধি করে আর অনিশ্চয়তা বাড়ায়।
বিদ্যমান প্রবিধানের অস্পষ্টতাগুলো অন্যায় পথে প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করে। ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা প্রায়ই সঠিক নিয়মের পরিবর্তে কর্মকর্তাদের দ্বারা সাব্জেক্টিভ জাজমেন্টের শিকার হয়, যার ফলে কার্গো ক্লিয়ারেন্সে বিলম্ব হয় এবং খরচ বৃদ্ধি পায়।
মাত্রাতিরিক্ত কর এবং ব্যাংকিং নীতি:
বাংলাদেশের ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে উচ্চ করের সম্মুখীন হয়, যেমন শিপিং লাইন এবং বিদেশী এজেন্টদের পেমেন্ট। এর সাথে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং অগ্রিম আয়কর (এআইটি), যা খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে। ফরমাল ব্যাঙ্কিং চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের উপরও উচ্চ কর আরোপ করা হয়, যা আর্থিক বোঝা আরো বৃদ্ধি করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগুলো এই অপারেশনকে আরও জটিল করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, বিল অফ লেডিং (বি/এল) (আন্তর্জাতিক শিপিং-এ প্রয়োজনীয় নথি) বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধ্যতামূলক মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ম্যানুয়াল যাচাইকরণ প্রক্রিয়ার কারণে অকার্যকর রয়ে গেছে। এই বিলম্ব সাপ্লাই চেইন ব্যাহত করে এবং অপারেশনাল খরচ বাড়ায়।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হল বিদেশী পরিষেবা প্রদানকারীদের অর্থ প্রদান করা। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং অত্যধিক ডকুমেন্টের প্রয়োজনীয়তার সম্মুখীন হয়, যা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে সম্পর্ককে চাপ দেয়। পেমেন্ট ট্রান্সফারে বিলম্বের ফলে জরিমানাও হয় এবং পারস্পরিক সুসম্পর্কের সুযোগ নষ্ট হয়।
শিপিং লাইন দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত অনুশীলন:
বাংলাদেশে শিপিং লাইনগুলি প্রায়ই পূর্ব নোটিশ বা যুক্তি ছাড়াই নির্বিচারে চার্জ আরোপ করে। বিলম্বিত কন্টেইনার রিটার্নের জন্য আটক চার্জ যা প্রায়ই বন্দর যানজট বা কাস্টমসের অদক্ষতার কারণে হয়, তা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের দ্বারা বহন করা অন্যায্য খরচের একটি প্রধান উদাহরণ।
অতিরিক্ত চার্জ, যেমন নন-শিডিউল ফি এবং অপ্রত্যাশিত বিলম্ব জরিমানা, এই বোঝা আরো বাড়ায়। কার্যকর নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি শিপিং লাইনের মধ্যে একচেটিয়া আচরণের সুযোগ দিয়েছে, যেখানে প্রভাবশালীরা ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এবং তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য শর্তাদি নির্দেশ করে। এই অব্যবস্থাপনা খরচ বাড়ায়, একটি অনৈতিক বাণিজ্য পরিবেশ তৈরি করে এবং দেশের বাণিজ্য খাতের প্রতিযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
বন্ডেড ওয়ারহাউজিং এবং কার্গো ভিলেজে চ্যালেঞ্জ:
বন্ডেড ওয়ারহাউজ বাণিজ্য সুবিধার জন্য অত্যাবশ্যক, কিন্তু অদক্ষতা এবং পুরানো প্রবিধানগুলি তাদের কার্যকারীতাকে বাঁধা দেয়। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা কিছু সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে, যার মধ্যে বন্ডেড ওয়ারহাউস লাইসেন্সগুলোকে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং লাইসেন্সের সাথে একত্রিত করা, যা অপারেশনের পথ সুগম করবে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা নির্বিচারে চার্জ, অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং কী পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই) এর জন্য সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিমানবন্দরে সিঙ্গেল এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম (ইডিএস) বাঁধা সৃষ্টি করে। যার ফলে পণ্যগুলো স্ক্রিনিংয়ে বিলম্ব হয়। অপ্রতুল জায়গার অভাবে যানজট হয় এবং পণ্যের অব্যবস্থাপনা হয় সাথে অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা চুরির বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ায়।
চট্টগ্রাম বন্দরের জটিলতা:
চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার। এটি অব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অপর্যাপ্ত বার্থ, ক্রেন এবং কন্টেইনার স্টোরেজ অসুবিধার কারণে সৃষ্ট যানজটের জন্য উল্লেখযোগ্য বিলম্ব হয়, বিশেষ করে দ্রুত রপ্তানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে।
ডেলিভারি না হওয়া কন্টেইনারগুলো এই সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডরা দাবিহীন চালানের ব্যাকলগ রিপোর্ট করে, যার ফলে শিপিং লাইন দ্বারা উচ্চ জরিমানা এবং কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এটি স্থানীয় অপারেশন এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন ব্যাহত করে। ১৯৬৯ সালের শুল্ক আইনের ধারা ৮২ কার্যকর করতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে এই সংকটের জন্য দায়ী করা হয়। এই ধারায় অদাবিকৃত পণ্যের সময়মত নিলামকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সমাধান এবং সুপারিশ:
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য অবিলম্বে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এখানে কিছু সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হলো:
স্ট্রীমলাইনিং লাইসেন্সিং-
সারা বাংলাদেশে একটি ইউনিফাইড লাইসেন্সিং সিস্টেম বাস্তবায়ন করা এবং আবেদন প্রক্রিয়াকে ডিজিটালাইজ করা।
শুল্ক পদ্ধতির সংস্কার-
বিলম্ব কমাতে এবং দক্ষতা উন্নত করতে কাস্টমস অপারেশন সহজীকরণ এবং ডিজিটালাইজ করা।
নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি-
শিপিং লাইনের মাধ্যমে একচেটিয়া চর্চা প্রতিরোধ করার জন্য মনিটরিংএর ব্যবস্থা স্থাপন করা।
পরিকাঠামো আধুনিকায়ন-
বন্ডেড ওয়ারহাউজ এবং বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণ করা, স্থানের সীমাবদ্ধতা দূর করা এবং উন্নত স্ক্রীনিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা।
ব্যাংকিং নীতির উন্নতি-
বিল অফ লেডিং এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন সহজভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবিধান আপডেট করা।
স্টেকহোল্ডার এনগেজমেন্ট-
প্রতিটি ধাপে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেগুলোর সমাধান নিশ্চিত করতে নীতি প্রণয়নে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের জড়িত করা।
বাংলাদেশে ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং সেক্টর তার বাণিজ্য-চালিত অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য কিন্তু অনেকগুলি পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। কাস্টমসের অদক্ষতা, শিপিং লাইনের একচেটিয়া চর্চা, পুরনো বিধিবিধান এবং অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো এই খাতের সম্ভাবনাকে আটকে রেখেছে।
বাণিজ্যিক পরিবেশের উন্নতির জন্য নীতির আধুনিকীকরণ, নিয়ন্ত্রকদের ওপর তদারকি বাড়ানো এবং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ সহ জরুরি সংস্কার অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার, নিয়ন্ত্রক এবং বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরিবর্তনগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, বাংলাদেশ তার ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং সেক্টরের পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে তার প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে পারে। এই উদ্যোগগুলোকে চালিত করতে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অবিলম্বে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা উচিত।